বাংলাভাষা সংস্কারে বিদ্যাসাগর
31/01/2011 14:55
জন্ম: ২৬সেপ্টেম্বর, ১৮২০ / ১২ আশ্বিন ১২২৭
মৃত্যু:২৯জুলাই, ১৮৯১ / ১৩শ্রাবণ, ১২৯৮
জীবনকাল ৭২ বছর
বাংলার প্রথম ভাষাবিজ্ঞানী সম্ভবত বিদ্যাসাগর শুধু তা-ই নয় তিনিই সম্ভবত ভাষাবিজ্ঞানের প্রথম প্রয়োগকারী তিনি বাংলাভাষার যে বিপুল সংস্কার করেছেন তা একজন ভাষাবিজ্ঞানীর পক্ষেই করা সম্ভব তাঁর হাতে বাংলা ভাষা সজীব প্রাণবন্ত হয়ে ওঠে বিদ্যাসাগরের আগে বাংলা ভাষা ছিল ৫০ বর্ণের, তার মধ্যে ১৬টি স্বরবর্ণ, এবং ৩৪টি ব্যঞ্জনবর্ণ বাংলায় প্রথম মুদ্রিত বই ন্যাথানিয়েল ব্রাসি হ্যালহেড সাহেবের ’আ গ্রামার অব বেংগল ল্যাংগুয়েজ‘(A Grammar of the Bengal Language) বলা ভাল বাংলা বিচল হরফে (moveable type) ছাপা এটিই প্রথম বাংলা বই আসলে বইখানি বাংলা নয় ইংরেজি বই, সেখানে বাংলা হরফে দেখানো প্রচুর বাংলা উদাহরণ আছে বইটি ছাপা হয় ১৭৭৮ খ্রিস্টাব্দে হুগলিতে, আর সেখানে এই ১৬+৩৪=৫০টি বাংলা বর্ণই দেখানো আছে
হ্যালহেড সাহেবের বইখানিতে র-এর তলায় বিন্দু ছিল না, বরং তা ছিল অসমীয়া হরফের মতো পেট কাটা ব [ৱ] স্বর এবং ব্যঞ্জনবর্ণের হরফগুলির আকৃতি পুরোটা বর্তমানের মতো ছিল না, একটু অন্যরকম ছিল যেমন স্বরবর্ণে -- উ,ঊ এই দুটির উপরকার ইলেক চিহ্ন বা টিকি ছিল গোলাকার তাই এদের চেহারা ছিল খানিকটা ঙ-এর মতো দেখতে স্বরবর্ণে ছিল ৠ(দীর্ঘ ঋ), ঌ(লি), ৡ(দীর্ঘ লি), এবং ছিল অং অঃ যদিও অং লিখতে কেবল উপরের বিন্দুটি ছিল, তলাকার হস্ চিহ্নের মতো অংশটি ছিল না, যেমন-- অ৹
ব্যঞ্জনবর্ণে ট এবং ঠ-এর আকৃতি কিছুটা ভিন্ন ছিল ঠ চেনাই যায় না আর তখনকার ণ দেখে এযুগের কেউ চিনতে পারবেন না সেটি ছিল ঠিক যেন ল তবে ল-এর মাত্রটি ছিল না, চেহারাটি ছিল-- আবার যুক্তবর্ণ হলেও ক্ষ ছিল বর্ণমালার মধ্যে কিছুদিন আগে অবধি বর্ণমালায় ক্ষ পড়ার রীতি চালু ছিল
হ্যালহেড সাহেবের বইয়ে ছাপা পাতায় ব্যঞ্জনবর্ণের প্রতিটি সারিতে ছিল ৫টি করে হরফ, তাই ৩৪টি ব্যঞ্জনবর্ণের সজ্জা করতে গিয়ে ব এবং শ এই দুটি হরফের মাঝে একটি ফাঁকা বোঝাতে একটি রেখা টানা ছিল বইটিতে বাংলা বর্ণমালা দেখানো হয়েছে পৃষ্ঠা ৪-এ সেখানে অবশ্য বাংলা স্বরবর্ণ বা বাংলা ব্যঞ্জনবর্ণ বলা হয়নি স্বরবর্ণকে বলা হয়েছে First Series আর ব্যঞ্জনবর্ণকে বলা হয়ছে Second Series. আরও মজার কথা যে বাংলা হরফকে বলা হয়েছে, Bengal alphabet বাংলা লিপি বলা হয়নি(পৃঃ-৬), আর ভাষাটির নামও সরাসরি বাংলাভাষা বলা হয়নি, বলা হয়েছে vernacular language of Bengal. (Preface পৃষ্ঠা ii, iii) তখনও কি বাংলা ভাষার নামটি ”বাংলাভাষা“ বলে প্রতিষ্ঠিত হয়নি? বইখানির নামকরণও করা হয়েছে-- A Grammar of the Bengal Language, যদিও বইখানির নামকরণ Bengali Language করলেই আরও প্রত্যক্ষ হত এত করেও কেমন যেন তা ভাসা ভাসা হয়েই রয়ে গেল এই বইটি ছাপা হওয়া বাংলাভাষার ইতিহাসে, এবং বাংলার ইতিহাসেও এক দিকচিহ্ন
বই ছাপার জন্য বাংলা হরফ চাই তা কোথায় কেমন করে পাওয়া যাবে? তাই নিজেরা উদ্যোগ নিয়ে বাংলা হরফে ছাপার টাইপই বানিয়ে ফেললেন এঁরা রীতিমতো এক উদ্ভাবন এর আগে বাংলা টাইপ ছিল না এ কাজটি করেন চার্লস উইলকিনস্ সাহেব এজন্য দেশীয় লোহার কারিগর পঞ্চানন কর্মকারকে তাঁরা কাজে লাগান তিনি ছেনি দিয়ে কেটে কেটে বাংলা হরফ তৈরি করেন তাঁর করা বাংলা হরফগুলি দেখতে বেশ সুন্দরই হয়েছিল আর এই ঐতিহাসিক কাজের জন্য ন্যাথানিয়েল ব্রাসি হ্যালহেড এবং চার্লস উইলকিনস্-এর সঙ্গে পঞ্চানন কর্মকারও ইতিহাসে উজ্জ্বল হয়ে আছেন
পলাশীর যুদ্ধ হয় ১৭৫৭-তে হ্যালহেড সাহেবের ব্যাকরণ বই ছাপা হয় ১৭৭৮ খ্রিস্টাব্দে, অর্থাৎ পলাশী যুদ্ধের ২১বছর পরে বিদ্যাসাগরের জন্ম পলাশী যুদ্ধের ৬৩ বছর পরে, তথা হ্যালহেড সাহেবের ব্যাকরণ বই ছাপার ৪২ বছর পরে বিদ্যাসাগরের জন্ম ১৮২০ খ্রস্টাব্দে(১৮২০-৯১, জীবনকাল ৭২ বছর)
পলাশী যুদ্ধ ১৭৫৭-- হ্যালহেড সাহেবের ব্যাকরণ বই ছাপা ১৭৭৮(২১ বছর পরে)-- বিদ্যাসাগরের জন্ম ১৮২০(যথাক্রমে ৬৩ বছর ও ৪২ বছর পরে) এই সাল তারিখগুলি খুবই গুরুত্বপূর্ণ কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় তৈরি হয়েছে ১৮৫৭খ্রিঃ ২৪ জানুয়ারি, আর তার এলাকা সুদূর রেঙ্গুন থেকে আগ্রা অবধি শ্রীলঙ্কাও এক সময় এর অধীনে ছিল কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় তৈরির দু-বছর আগে ১৮৫৫তে বিদ্যাসাগরের ”বর্ণপরিচয়“ প্রকাশিত হয় তখন ভারত এবং বাংলা অবিভক্ত, বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষমতা অনেক, আর বিদ্যাসাগর তখন বিদ্যা শিরোমণি, তিনি উচ্চপদাধিকারী তাই সে যুগে বাংলা ভাষার এমন ব্যাপক সংস্কার করা তাঁর পক্ষে সম্ভব হয়েছিল এযুগে তা কারও পক্ষেই সম্ভব নয় বঙ্গদেশ বিভক্ত, বিশ্ববিদ্যালয় একাধিক, তাদের এলাকা সীমিত বিদ্যাসাগরের হাত ধরে শিক্ষার অনেক প্রসার ও বিকাশ ঘটেছে তাই একক সংস্কার এযুগে কেউ মানবেন না
বিদ্যাসাগরের হাতে একক সংস্কার হলেও, বাংলা ভাষার তিনি যা সংস্কার করেছেন তার মধ্যে অযৌক্তিক কিছু নেই, বা বাহুল্য কিছু নেই ফলে তা সহজে দেশের মানুষ মেনে নিয়েছেন তিনি নিজে শিশুদের জন্য বই ছেপে শিক্ষার বিস্তারে সর্বশক্তি নিয়ে লেগে পড়েছেন তার শিক্ষাবিস্তার প্রয়াসের ফলে বাংলার নারীশিক্ষা নতুন দিগন্ত পেয়েছে সামগ্রিক শিক্ষা বিস্তারে বিদ্যাসাগরের অবদান চিরকালীন
বিদ্যাসাগরের সময়কালে যে পারিপার্শ্বিক জীবন ও ঘটনাবলী তাও একটু এ প্রসঙ্গে আলোচনা করা দরকার
তখন নব্য আধুনিক যুগের সূচনা হচ্ছে-- বিজলি বাতি, রেল লাইন, টেলিগ্রাফ, টেলিফোন, গ্রামোফোন, কলের জল, কিছু পরে এলো মোটর গাড়ি-- মানুষের চোখ ধাঁধিয়ে যাচ্ছে বিদ্যাসাগর নিজে বিধবাবিবাহ প্রবর্তন চেষ্টায় সফল এবং নিজপুত্রের সঙ্গে বিধবাবিবাহ দেন কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়(১৮৫৭, ২৪ জানুয়ারি)
মনে রাখতে হবে কোলকাতা তখন ভারতের রাজধানী কোলকাতা থেকে ভারতের রাজধানী দিল্লিতে অপসারিত হয় ১৯১১খ্রিস্টাব্দের ১২ ডিসেম্বর বর্ণপরিচয় প্রকাশের ৫৬ বছর পরে ডিরোজিওর ইয়ংবেঙ্গল দলের প্রভাব তুঙ্গে ডিরোজিওর মৃত্যুর ২৪ বছর পরে বর্ণপরিচয় প্রকাশিত হয় কোলকাতা এবং বাংলা জুড়ে সে এক হৈ-হৈ ব্যাপার নব উন্মেষের আলোয় মানুষ অনেকটা যেন দিশেহারা-- ইয়ংবেঙ্গলেরা তৎকালীন সমাজ-ব্যবস্থা মানছেন না, হিন্দু থেকে খ্রিস্টান হচ্ছেন, যুক্তি দিয়ে সব বিচার করতে চাইছেন পুরানো ব্যবস্থা আর ধরে রাখা যাচ্ছে না অসবর্ণ বিয়ে হচ্ছে, ’কাদম্বিনী গঙ্গোপাধ্যায় ও চন্দ্রমুখী বসু ব্রিটিশ দ্বীপপুঞ্জ সহ ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের প্রথম মহিলা গ্রাজুয়েট হলেন‘, উচ্চশিক্ষার জন্য মানুষ বিলেত যাচ্ছেন, নতুন নতুন উদ্ভাবন ও নব আলোকে মানুষ জেগে উঠছেন
বিদ্যাসাগর যখন মারা যান(২৯জুলাই, ১৮৯১) তখন রবীন্দ্রনাথের বয়স ৩০ বছর(জন্ম:৭মে, ১৮৬১) সুতরাং তাঁদের পরস্পরের উপরে প্রভাব সেই মুহূর্তে ছিল বিদ্যাসাগর যখন মারা যান সেই ১৮৯১-তে রবীন্দ্রনাথের দ্বিতীয়া কন্যা রেণুকার জন্ম হয় বিদ্যাসাগরের সমসাময়িক (আগে, পরে) যাঁরা ছিলেন তাঁরা হলেন--
বিদ্যাসাগরের আগে জন্ম---
হেনরি ভিভিয়ান ডিরোজিও(১৮০৯-৩১)[২৩] বাংলার নবজাগরণের হোতা জীবনকাল মাত্র ২৩ বছর
ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত(১৮১২-৫৯)[৪৮] কবি
রাধানাথ শিকদার(১৮১৩-৭০)[৫৮]হিমালয়ের এভারেস্ট শৃঙ্গের উচ্চতা নির্ধারণ করেন
রেভারেন্ড কৃষ্ণমোহন বন্দ্যোপাধ্যায়(১৮১৩-৮৫)[৭৩]ডিরোজিওর শিষ্যখ্রিস্ট যাজক
রামতনু লাহিড়ী(১৮১৩-৯৮)[৮৬] শিক্ষাব্রতী, বিদ্যাসাগরের সহায়ক
প্যারীচাঁদ মিত্র(১৮১৪-৮০)[৬৭] টেকচাঁদ ঠাকুর লেখক ও মুক্তচিন্তার মানুষ
রেভারেন্ড জেমস লং(১৮১৪-৮৭)[৭৪] বাংলাভাষা ও সাহিত্যের উন্নয়নে বিশেষ যত্নশীল ছিলেন বাংলা প্রবাদ বচন সংগ্রহ তাঁর অন্যতম কীর্তি
মদনমোহন তর্কালঙ্কার(১৮১৭-৫৮)[৪২] শিশুশিক্ষা বইয়ের লেখক, ’পাখি সব করে রব‘ তাঁর লেখা, বিদ্যাসাগরের সঙ্গী আন্দোলনকারী তাঁর নামটা যত প্রাচীন কর্মে ততো আধুনিক
বিদ্যাসাগরের পরে---
অক্ষয়কুমার দত্ত(১৮২০-৮৬)[৬৭] সাহিত্যসাধক, সমাজসংস্কারক
রামনারায়ণ তর্করত্ন(১৮২২-৮৬)[৬৫] নাট্যকার ’কুলীনকুল সর্বস্ব‘ তাঁর রচনা
রাজেন্দ্রলাল মিত্র(১৮২২-৯১)[৭০] ভারত চর্চার অন্যতম পথিকৃৎ
হরিশ্চন্দ্র মুখোপাধ্যায়(১৮২৪-৬১)[৩৮] নির্ভীক ইতিহাসখ্যাত সাংবাদিক
মধুসূদন দত্ত(১৮২৪-৭৩)[৫০] ’মেঘনাদ বধ‘ কাব্য রচয়িতা অমর কবি, নাট্যকার
রেভারেন্ড লালবিহারী দে(১৮২৪-৯৪)[৭১] শিক্ষাব্রতী, লেখক, সাংবাদিক, যাজক
ভূদেব মুখোপাধ্যায়(১৮২৭-৯৪)[৬৮] শিক্ষাব্রতী, মাইকেল মধুসূদনের সহপাঠী বন্ধু, বিদ্যাসাগরের বিধবা-বিবাহ প্রস্তাব তিনি সমর্থন করেননি
শ্যামাচরণ লাহিড়ি(১৮২৮-৯৫)[৬৮] গৃহী সন্ন্যাসী
দীনবন্ধু মিত্র(১৮৩০-৭৩)[৪৪] নীলদর্পণ নাটকের লেখক
তারকনাথ পালিত(১৮৩১-১৯১৪)[৮৪] এঁর দান করা বাড়িতে ক.বি. সায়েন্স কলেজ
কাঙাল হরিনাথ[মজুমদার](১৮৩৩-৯৬)[৬৪] সাংবাদিক
মহেন্দ্রলাল সরকার(১৮৩৩-১৯০৪)[৭২] চিকিৎসক(এয্লোপ্যাথি পরে হোমিওপ্যাথি)
বিহারীলাল চক্রবর্তী(১৮৩৫-৯৪)[৬০] কবি
’ভাই‘ গিরিশচন্দ্র সেন(১৮৩৫-১৯১০)[৭৬]কোরান শরীফের বাংলা অনুবাদক
শ্রীশচন্দ্র বিদ্যারত্ন(●--●) বিদ্যাসাগরের অনুজপ্রতিম বন্ধু সংস্কৃত কলেজের অধ্যাপক বিধবা বিবাহ আইন পাশ হবার পরে বালিকা বিধবা কালীমতী দেবীকে ১৮৫৬, ৭ডিসেম্বর তিনিই প্রথম বিবাহ করে সেযুগের রক্ষণশীল সমাজে বিপ্লবের সূচনা করেন
রামকৃষ্ণ পরমহংস(১৮৩৬-৮৬)[৫১] গদাধর চট্টোপাধ্যায় কালী সাধক যুগপুরুষ
ব্রহ্মানন্দ কেশবচন্দ্র সেন(১৮৩৮-৮৪)[৪৭] সমাজ সংস্কারক, জাতীয় চেতনার অন্যতম সূচনাকার
বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়(১৮৩৮-৯৪)[৫৭] সাহিত্যসম্রাট ’বন্দেমাতরম‘ সংগীত তাঁর রচনা
বামাক্ষ্যাপা(১৮৩৮-১৯১১)[৭৪] বামাচরণ চট্টোপাধ্যায় তারাপীঠের কালী সাধক
কালীপ্রসন্ন সিংহ(১৮৪০-৭০)[৩১] হুতোম প্যাঁচার নক্সা-র লেখক
সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর(১৮৪২-১৯২৩)[৮২] ভারতের প্রথম আইসিএস(১৮৬৪)
উমেশচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়(১৮৪৪-১৯০৬)[৬৩][ডবলিউ সি ব্যানার্জি]কংগ্রেসের প্রথম সভাপতি
গিরিশচন্দ্র ঘোষ(১৮৪৪-১৯১২)[৬৯] নাট্যকার, অভিনেতা, গীতিকার
স্যার গুরুদাস বন্দ্যোপাধ্যায়(১৮৪৪-১৯১৮)[৭৫] কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম ভারতীয় ভাইস চ্যান্সেলর
শিবনাথ শাস্ত্রী(১৮৪৭-১৯১৯)[৭৩] লেখক, ব্রাহ্ম ধর্ম আন্দোলনের নেতা, বিদ্যাসাগরের সকল সমাজসংস্কারের সমর্থক
রমেশচন্দ্র দত্ত(১৮৪৮-১৯০৯)[৬২] ঐতিহাসিক, ঋক্বেদ সংহিতার অনুবাদক
সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়(১৮৪৮-১৯২৫)[৭৮] রাষ্ট্রগুরু বিশিষ্ট রাজীতিবিদ ১৯০৫-এর বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে খ্যাত
জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর(১৮৪৯-১৯২৫)[৭৭] বহুমুখী প্রতিভা সাহিত্যিক, বহু ব্যবসার উদ্যোগী, দেশপ্রেমিক, একাধিক ভাষায় দক্ষ, ছবি আঁকা, সংগীতে দক্ষ এবং বাদক, ঠাকুর বাড়ির সন্তান রবীন্দ্রনাথের বিকাশের প্রধান সহায়ক বড়দাদা
জ্ঞানদানন্দিনী দেবী(১৮৫১-১৯৪১)[৯১] জোড়াসাঁকোর ঠাকুর বাড়ির বধূ, বঙ্গনারীর সাজের দিশারী
মীর মোশারফ হোসেন(১৮৫৩-১৯২২)[৭০] বিষাদসিন্ধু, জমিদার দর্পণ গ্রন্থের লেখক
হরপ্রসাদ শাস্ত্রী(১৮৫৩-১৯৩৯)[৮৭] সংস্কৃত পণ্ডিত, বাংলাভাষা গবেষক নেপাল থেকে দুর্লভ প্রাচীন পুথি সংগ্রহ করে বাংলাভাষার আদি গ্রন্থ ”চর্চাচর্য বিনিশ্চয়“ তথা ’হাজার বছরের পুরান বাংলা ভাষায় বৌদ্ধ গান ও দোঁহা‘ প্রকাশ করেন
জগদীশ চন্দ্র বসু(১৮৫৯-১৯৩৭)[৭৯] বিজ্ঞানী, গবেষক, উদ্ভিদের চেতনা বিষয়ে নতুন ধারণার প্রকাশক
চন্দ্রমুখী বসু(১৮৬০-১৯৪৪)[৮৫] প্রথম বাঙালি মহিলা ক.বি. থেকে এম.এ.
ব্রহ্মবান্ধব উপাধ্যায়(১৮৬১-১৯০৭)[৪৭] প্রকৃত নাম ভবানীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় খ্রিস্টান হন, পরে আবার হিন্দু শান্তিনিকেতনের আশ্রমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক
কাদম্বিনী গঙ্গোপাধ্যায়(১৮৬১-১৯২৩)[৬৩] পণ্ডিত, প্রথম প্রবেশিকা পরীক্ষায় পাশ, ও প্রথম গ্রাজুয়েট(চন্দ্রমুখী বসু সহ) মহিলা
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর(১৮৬১-১৯৪১, বাংলা ২৫ বৈশাখ ১২৬৮ - ২২শ্রাবণ ১৩৪৮)[৮১] বাংলা সাহিত্য, সংগীত, সংস্কৃতির দিশারী ইউরোপের বাইরে সাহিত্যে প্রথম নোবেল প্রাপক বিশ্বভারতীর প্রতিষ্ঠাতা
নীলরতন সরকার(১৮৬১-১৯৪৩)[৮৩] চিকিৎসক
আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়(১৮৬১-১৯৪৪)[৮৪] দেশজ বিজ্ঞানে আগ্রহী বিজ্ঞানী, বেঙ্গল কেমিক্যালের প্রতিষ্ঠাতা বাঙালির উন্নয়নে আত্মনিবেদিত
এসকল তারকা সন্নিবেশ ঘটেছিল বিদ্যাসাগরের কালে ফলে যে সামগ্রিক সামাজিক প্রভাব তাঁর উপরে পড়েছিল তা আমরা দেখি তাঁর শিক্ষা বিস্তার প্রয়াসে, সমাজ উন্নয়নের কার্যাবলীর মধ্যে তখনকার দিনের গোঁড়া সমাজে তিনি ছিলেন সম্পূর্ণ ব্যতিক্রম তাঁর অগ্রগত ও উন্নত চিন্তাধারার সুফল আজ আমরা পাচ্ছি অথচ তাঁকে যে কত হেনস্থা হতে হয়েছে ও অপমান সহ্য করতে হয়েছে তা এযুগে দাঁড়িয়ে অনুভব করা কঠিন (একজন খ্যাত গায়ক তাঁর স্মৃতিচারণে সভায় দাঁড়িয়ে বলেছেন যে, বিদ্যাসাগরকে বাংলা থেকে তাড়াবার কালে ট্রেনের স্টেশনে তাঁর পিছনে ঘণ্টাকাঁসি বাজিয়ে দূর করে দেওয়া হয় এই ঘটনায় ব্যথিত সেই গায়কের পরিবারে তিনদিন অরন্ধন শোক পালন করা হয়) বিদ্যাসাগর দেশ ও সমাজের জন্য নিজের জীবন উৎসর্গ করেছিলেন তিনি তাঁর উচ্চ আয়ের প্রায় সবটাই বিলিয়ে দিয়ে নিজে অতি সাধারণভাবে জীবনযাপন করতেন তিনি সমাজ সংস্কার করেন, এবং শিক্ষা সংস্কার যেমন করেন তেমনি বাংলাভাষার যে অভাবিত সংস্কার ও উন্নয়ন ঘটান তার ফলে বাংলাভাষা আজ এত উন্নত ও সমৃদ্ধ তাঁর এই কাজের মূল বাহন হল তাঁর রচিত ”বর্ণপরিচয়“ শিশুপাঠ্য প্রাথমিক গ্রন্থ তিনি ”বর্ণপরিচয়“ লেখেন তাঁর ৩৬ বছর বয়সে (প্রথম প্রকাশকাল ১৩ এপ্রিল, ১৮৫৫) শোনা যায় তিনি যখন স্কুল পরিদর্শক ছিলেন, সে সময়ে কার্য উপলক্ষে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে যাবার ফাঁকে পালকিতে বসে বইখানি লেখেন সম্ভবত স্কুলে বাংলা শিক্ষার যে দুরবস্থা তিনি দেখেন তা তাঁকে নাড়া দেয়, ও তিনি সঙ্গে সঙ্গে একখানি উপযুক্ত প্রাথমিক শিক্ষার বই(প্রাইমার) লেখায় হাত দেন এটা তাঁর প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার ফল বলেই মনে হয় তিনি নিজে ছিলেন সংস্কৃতের মহা পণ্ডিত, তাঁর চেতনা-বাহিত হয়ে এমন যুগান্তকারী বই আমরা বাংলার শিশুদের জন্য পেয়েছি বাংলাভাষীদের জন্য পেয়েছি বিদ্যাসাগর, রবীন্দ্রনাথ প্রমুখ অতি খ্যাত এবং মহাব্যস্ত মানুষেরা যে বাংলাভাষা ও শিশুশিক্ষার জন্য ভেবেছিলেন ও সময় দিয়েছিলেন তার পরিণত সুফল আমরা প্রজন্ম ধরে পেয়ে চলেছি
বিদ্যাসাগর বাংলা বর্ণমালা থেকে অনেকগুলি বর্ণ বর্জন করেন, এবং অনেকগুলি বর্ণ গ্রহণ ও নতুন বর্ণ নির্মাণ করেন
বাংলা স্বরবর্ণ থেকে তিনি বর্জন করেন-- ৠ(দীর্ঘ ঋ), ৡ(দীর্ঘ লি), এবং অং অঃ এই মোট চারটি বর্ণ ফলে বাংলা স্বরবর্ণ প্রচলিত ১৬টি থেকে হয়ে দাঁড়ায় ১২টি আগে ছিল(ন্যাথানিয়েল ব্রাসি হ্যালহেড সাহেবের ’আ গ্রামার অব বেংগল ল্যাংগুয়েজ‘(A Grammar of the Bengal Language)বইতে --
অ আ ই ঈ
উ ঊ ঋ ৠ
ঌ ৡ এ ঐ
ও ঔ অ৹ অঃ
বাংলা বর্ণমালায় এই মোট=১৬টি স্বরবর্ণ
এর থেকে ৠ(দীর্ঘ ঋ), ৡ(দীর্ঘ লি), অং[তখন অং ছিল=অ৹], অঃ এই মোট চারটি বর্ণ বর্জন করায় তা বিদ্যাসাগরের ”বর্ণপরিচয়“ বইতে দাঁড়ায় --
অ আ ই ঈ উ ঊ ঋ ঌ এ ঐ ও ঔ= ১২টি স্বরবর্ণ
বিদ্যাসাগর বাংলা ব্যঞ্জনবর্ণও একইভাবে সংস্কার করেন তাঁর আগে ন্যাথানিয়েল ব্রাসি হ্যালহেড সাহেবের ’আ গ্রামার অব বেংগল ল্যাংগুয়েজ‘(A Grammar of the Bengal Language)বইতে ব্যঞ্জনবর্ণ ছিল--
ক খ গ ঘ ঙ
চ ছ জ ঝ ঞ
ট ঠ ড ঢ ণ
ত থ দ ধ ন
প ফ ব ভ ম
য র ল ব __
শ ষ স হ ক্ষ
বাংলা বর্ণমালায় এই মোট=৩৪টি ব্যঞ্জনবর্ণ
এখানে ণ-এর রূপ ছিল অনেকটা ’ল‘-এর মতো [ ] আর র ছিল অসমীয়া হরফের মতো ৱ আর ঠ ছিল অনেকটা চ-এর মতো কেবল মাত্রার পিছনে একটু উঁচু করে রেখা টানা ঞ-এর মাত্রা ছিল ট-এর মাত্রা ছিল, আর ট-এর ইলেক বা টিকি ছিল মাত্রার নীচেই
চিত্রে দেখা যাক
ড় ঢ় য় ং ঃ এই মোট পাঁচটি এতে ব্যঞ্জনবর্ণ দাঁড়ায় মোট ৩৮ বর্ণ তিনি নতুন বর্ণ নির্মাণ করেন একটি ” ঁ “ এতে ব্যঞ্জনবর্ণ দাঁড়ায় মোট ৩৯ বর্ণ এর পরে বিদ্যাসাগর ব্যঞ্জনবর্ণে আর একটি নতুন বর্ণ যোগ করেন, ” ৎ “, ফলে মোট বাংলা ব্যঞ্জনবর্ণ দাঁড়ায় ৪০টি
একটি বর্ণ(ক্ষ) বর্জন, পাঁচটি বর্ণ(ড়ঢ়য় ং ঃ) গ্রহণ, দুটি বর্ণ ( ঁ ৎ) নির্মাণ ইত্যাদি করার পরে বিদ্যাসাগরের ”বর্ণপরিচয়“ বইতে মোট বাংলা বর্ণ দাঁড়ায়-- ৩৪-১=৩৩+৫=৩৮+২=৪০
তাঁর সংস্কার করা বাংলা ব্যঞ্জনবর্ণসমূহ হল--
ক খ গ ঘ ঙ
চ ছ জ ঝ ঞ
ট ঠ ড ঢ ণ
ত থ দ ধ ন
প ফ ব ভ ম
য র ল ব শ
ষ স হ ড় ঢ়
য় ৎ ং ঃ ঁ
বাংলা বর্ণমালায় এই মোট=৪০টি ব্যঞ্জনবর্ণ
সাম্প্রতিক --
১৯৮১-তে পশ্চিমবঙ্গ সরকার ব্যঞ্জনবর্ণ থেকে অন্তস্থ-ব(ৱ) বাতিল করায় ব্যঞ্জনবর্ণ দাঁড়ায়= ৩৯ বর্ণ
আর ব্যবহারের অভাবে বাংলা স্বরবর্ণ থেকে আপনিই বাতিল হয়ে যায় ঌ(লি) বর্ণটি তাই বাংলা স্বরবর্ণ দাঁড়ায় =১১টি
ফলে চূড়ান্তভাবে বাংলা বর্ণমালা হয়েছে ১২-১=১১, ৪০-১=৩৯ সুতরাং বাংলা বর্ণমালায় বর্তমানে মোট বর্ণ দাঁড়িয়েছে ১১+৩৯=৫০টি
বাংলা বর্ণমালা বিদ্যাসাগরের আগে ছিল ৫০টি, সেখান থেকে বিদ্যাসাগরের হাতে হয় ৫২টি, পরে ঌ বিলুপ্ত ও অন্তস্থ-ব বর্জিত হয়ওয়ায় এখন চূড়ান্তভাবে মোট বাংলা বর্ণমালা হয়েছে ১১+৩৯=৫০টি
=========
Tags:
———
Back