হৃদয়ের টানে ছুটে চলি আমরা......

বাংলাভাষা সংস্কারে বিদ্যাসাগর

31/01/2011 14:55

                            জন্ম: ২৬সেপ্টেম্বর, ১৮২০  /  ১২ আশ্বিন ১২২৭

                                 মৃত্যু:২৯জুলাই, ১৮৯১  /  ১৩শ্রাবণ, ১২৯৮

                                           জীবনকাল ৭২ বছর৤

 

       বাংলার প্রথম ভাষাবিজ্ঞানী সম্ভবত বিদ্যাসাগর৤ শুধু তা-ই নয় তিনিই সম্ভবত ভাষাবিজ্ঞানের প্রথম প্রয়োগকারী৤ তিনি বাংলাভাষার যে বিপুল সংস্কার করেছেন তা একজন ভাষাবিজ্ঞানীর পক্ষেই করা সম্ভব৤ তাঁর হাতে বাংলা ভাষা সজীব প্রাণবন্ত হয়ে ওঠে৤ বিদ্যাসাগরের আগে বাংলা ভাষা ছিল ৫০ বর্ণের, তার মধ্যে ১৬টি স্বরবর্ণ, এবং ৩৪টি ব্যঞ্জনবর্ণ৤ বাংলায় প্রথম মুদ্রিত বই ন্যাথানিয়েল ব্রাসি হ্যালহেড সাহেবের ’আ গ্রামার অব বেংগল ল্যাংগুয়েজ‘(A Grammar of the Bengal Language)৤ বলা ভাল বাংলা বিচল হরফে (moveable type) ছাপা এটিই প্রথম বাংলা বই৤ আসলে বইখানি বাংলা নয় ইংরেজি বই, সেখানে বাংলা হরফে দেখানো প্রচুর বাংলা উদাহরণ আছে৤ বইটি ছাপা হয় ১৭৭৮ খ্রিস্টাব্দে হুগলিতে, আর সেখানে এই ১৬+৩৪=৫০টি বাংলা বর্ণই দেখানো আছে৤

       হ্যালহেড সাহেবের বইখানিতে র-এর তলায় বিন্দু ছিল না, বরং তা ছিল অসমীয়া হরফের মতো পেট কাটা ব [ৱ]৤ স্বর এবং ব্যঞ্জনবর্ণের হরফগুলির আকৃতি পুরোটা বর্তমানের মতো ছিল না, একটু অন্যরকম ছিল৤ যেমন স্বরবর্ণে -- উ,ঊ এই দুটির উপরকার ইলেক চিহ্ন বা টিকি ছিল গোলাকার তাই এদের চেহারা ছিল খানিকটা ঙ-এর মতো দেখতে৤ স্বরবর্ণে ছিল ৠ(দীর্ঘ ঋ), ঌ(লি), ৡ(দীর্ঘ লি), এবং ছিল অং অঃ৤ যদিও অং লিখতে কেবল উপরের বিন্দুটি ছিল, তলাকার হস্ চিহ্নের মতো অংশটি ছিল না, যেমন--  অ৹ ৤

       ব্যঞ্জনবর্ণে ট এবং ঠ-এর আকৃতি কিছুটা ভিন্ন ছিল৤ ঠ চেনাই যায় না৤ আর তখনকার ণ দেখে এযুগের কেউ চিনতে পারবেন না৤ সেটি ছিল ঠিক যেন ল৤ তবে ল-এর মাত্রটি ছিল না, চেহারাটি ছিল-- ৤ আবার যুক্তবর্ণ হলেও ক্ষ ছিল বর্ণমালার মধ্যে৤ কিছুদিন আগে অবধি বর্ণমালায় ক্ষ পড়ার রীতি চালু ছিল৤

       হ্যালহেড সাহেবের বইয়ে ছাপা পাতায় ব্যঞ্জনবর্ণের প্রতিটি সারিতে ছিল ৫টি করে হরফ, তাই ৩৪টি ব্যঞ্জনবর্ণের সজ্জা করতে গিয়ে ব এবং শ এই দুটি হরফের মাঝে একটি ফাঁকা বোঝাতে একটি রেখা টানা ছিল৤ বইটিতে বাংলা বর্ণমালা দেখানো হয়েছে পৃষ্ঠা ৪-এ৤ সেখানে অবশ্য বাংলা স্বরবর্ণ বা বাংলা ব্যঞ্জনবর্ণ বলা হয়নি৤ স্বরবর্ণকে বলা হয়েছে First Series আর ব্যঞ্জনবর্ণকে বলা হয়ছে Second Series.  আরও মজার কথা যে বাংলা হরফকে বলা হয়েছে, Bengal alphabet বাংলা লিপি বলা হয়নি(পৃঃ-৬), আর ভাষাটির নামও সরাসরি বাংলাভাষা বলা হয়নি, বলা হয়েছে vernacular language of Bengal. (Preface পৃষ্ঠা ii, iii)৤ তখনও কি বাংলা ভাষার নামটি ”বাংলাভাষা“ বলে প্রতিষ্ঠিত হয়নি? বইখানির নামকরণও করা হয়েছে-- A Grammar of the Bengal Language, যদিও বইখানির নামকরণ Bengali Language করলেই আরও প্রত্যক্ষ হত৤ এত করেও কেমন যেন তা ভাসা ভাসা হয়েই রয়ে গেল৤ এই বইটি ছাপা হওয়া বাংলাভাষার ইতিহাসে, এবং বাংলার ইতিহাসেও এক দিকচিহ্ন৤

         

        

বঙ্গের হুগলিতে মুদ্রিত  A Grammar of the Bengal Language  1778(১৭৭৮)  বইয়ের প্রচ্ছদ
 

     বই ছাপার জন্য বাংলা হরফ চাই৤ তা কোথায় কেমন করে পাওয়া যাবে? তাই নিজেরা উদ্যোগ নিয়ে বাংলা হরফে ছাপার টাইপই বানিয়ে ফেললেন এঁরা৤ রীতিমতো এক উদ্ভাবন৤ এর আগে বাংলা টাইপ ছিল না৤ এ কাজটি করেন চার্লস উইলকিনস্ সাহেব৤ এজন্য দেশীয় লোহার কারিগর পঞ্চানন কর্মকারকে তাঁরা কাজে লাগান৤ তিনি ছেনি দিয়ে কেটে কেটে বাংলা হরফ তৈরি করেন৤ তাঁর করা বাংলা হরফগুলি দেখতে বেশ সুন্দরই হয়েছিল৤ আর এই ঐতিহাসিক কাজের জন্য ন্যাথানিয়েল ব্রাসি হ্যালহেড এবং চার্লস উইলকিনস্-এর সঙ্গে পঞ্চানন কর্মকারও ইতিহাসে উজ্জ্বল হয়ে আছেন৤

       পলাশীর যুদ্ধ হয় ১৭৫৭-তে৤ হ্যালহেড সাহেবের ব্যাকরণ বই ছাপা হয় ১৭৭৮ খ্রিস্টাব্দে, অর্থাৎ পলাশী যুদ্ধের ২১বছর পরে৤ বিদ্যাসাগরের জন্ম পলাশী যুদ্ধের ৬৩ বছর পরে, তথা হ্যালহেড সাহেবের ব্যাকরণ বই ছাপার ৪২ বছর পরে৤ বিদ্যাসাগরের জন্ম ১৮২০ খ্রস্টাব্দে(১৮২০-৯১, জীবনকাল ৭২ বছর)৤

       পলাশী যুদ্ধ ১৭৫৭--  হ্যালহেড সাহেবের ব্যাকরণ বই ছাপা ১৭৭৮(২১ বছর পরে)-- বিদ্যাসাগরের জন্ম ১৮২০(যথাক্রমে ৬৩ বছর ও ৪২ বছর পরে)৤ এই সাল তারিখগুলি খুবই গুরুত্বপূর্ণ৤ কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় তৈরি হয়েছে ১৮৫৭খ্রিঃ ২৪ জানুয়ারি, আর তার এলাকা সুদূর রেঙ্গুন থেকে আগ্রা অবধি৤ শ্রীলঙ্কাও এক সময় এর অধীনে ছিল৤ কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় তৈরির দু-বছর আগে ১৮৫৫তে বিদ্যাসাগরের ”বর্ণপরিচয়“ প্রকাশিত হয়৤ তখন ভারত এবং বাংলা অবিভক্ত, বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষমতা অনেক, আর বিদ্যাসাগর তখন বিদ্যা শিরোমণি, তিনি উচ্চপদাধিকারী৤ তাই সে যুগে বাংলা ভাষার এমন ব্যাপক সংস্কার করা তাঁর পক্ষে সম্ভব হয়েছিল৤ এযুগে তা কারও পক্ষেই সম্ভব নয়৤ বঙ্গদেশ বিভক্ত, বিশ্ববিদ্যালয় একাধিক, তাদের এলাকা সীমিত৤ বিদ্যাসাগরের হাত ধরে শিক্ষার  অনেক প্রসার ও বিকাশ ঘটেছে৤ তাই একক সংস্কার এযুগে কেউ মানবেন না৤

       বিদ্যাসাগরের হাতে একক সংস্কার হলেও, বাংলা ভাষার তিনি যা সংস্কার করেছেন তার মধ্যে অযৌক্তিক কিছু নেই, বা বাহুল্য কিছু নেই৤ ফলে তা সহজে দেশের মানুষ মেনে নিয়েছেন৤ তিনি নিজে শিশুদের জন্য বই ছেপে শিক্ষার বিস্তারে সর্বশক্তি নিয়ে লেগে পড়েছেন৤ তার শিক্ষাবিস্তার প্রয়াসের ফলে বাংলার নারীশিক্ষা নতুন দিগন্ত পেয়েছে৤ সামগ্রিক শিক্ষা বিস্তারে বিদ্যাসাগরের অবদান চিরকালীন৤

       বিদ্যাসাগরের সময়কালে যে পারিপার্শ্বিক জীবন ও ঘটনাবলী তাও একটু এ প্রসঙ্গে আলোচনা করা দরকার৤

       তখন নব্য আধুনিক যুগের সূচনা হচ্ছে-- বিজলি বাতি, রেল লাইন, টেলিগ্রাফ, টেলিফোন, গ্রামোফোন, কলের জল, কিছু পরে এলো মোটর গাড়ি-- মানুষের চোখ ধাঁধিয়ে যাচ্ছে৤ বিদ্যাসাগর নিজে বিধবাবিবাহ প্রবর্তন চেষ্টায় সফল এবং নিজপুত্রের সঙ্গে বিধবাবিবাহ দেন৤ কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়(১৮৫৭, ২৪ জানুয়ারি)৤

       মনে রাখতে হবে কোলকাতা তখন ভারতের রাজধানী৤ কোলকাতা থেকে ভারতের রাজধানী দিল্লিতে অপসারিত হয় ১৯১১খ্রিস্টাব্দের ১২ ডিসেম্বর৤ বর্ণপরিচয় প্রকাশের ৫৬ বছর পরে৤ ডিরোজিওর ইয়ংবেঙ্গল দলের প্রভাব তুঙ্গে৤ ডিরোজিওর মৃত্যুর ২৪ বছর পরে বর্ণপরিচয় প্রকাশিত হয়৤ কোলকাতা এবং বাংলা জুড়ে সে এক হৈ-হৈ ব্যাপার৤ নব উন্মেষের আলোয় মানুষ অনেকটা যেন দিশেহারা-- ইয়ংবেঙ্গলেরা তৎকালীন সমাজ-ব্যবস্থা মানছেন না, হিন্দু থেকে খ্রিস্টান হচ্ছেন, যুক্তি দিয়ে সব বিচার করতে চাইছেন৤ পুরানো ব্যবস্থা আর ধরে রাখা যাচ্ছে না৤ অসবর্ণ বিয়ে হচ্ছে, ’কাদম্বিনী গঙ্গোপাধ্যায় ও চন্দ্রমুখী বসু ব্রিটিশ দ্বীপপুঞ্জ সহ ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের প্রথম মহিলা গ্রাজুয়েট হলেন‘,  উচ্চশিক্ষার জন্য মানুষ বিলেত যাচ্ছেন, নতুন নতুন উদ্ভাবন ও নব আলোকে মানুষ জেগে উঠছেন৤

 

       বিদ্যাসাগর যখন মারা যান(২৯জুলাই, ১৮৯১) তখন রবীন্দ্রনাথের বয়স ৩০ বছর(জন্ম:৭মে, ১৮৬১)৤ সুতরাং তাঁদের পরস্পরের উপরে প্রভাব সেই মুহূর্তে ছিল৤ বিদ্যাসাগর যখন মারা যান সেই ১৮৯১-তে রবীন্দ্রনাথের দ্বিতীয়া কন্যা রেণুকার জন্ম হয়৤ বিদ্যাসাগরের সমসাময়িক (আগে, পরে) যাঁরা ছিলেন তাঁরা হলেন--

 

বিদ্যাসাগরের আগে জন্ম---

হেনরি ভিভিয়ান ডিরোজিও(১৮০৯-৩১)[২৩] বাংলার নবজাগরণের হোতা৤ জীবনকাল মাত্র ২৩ বছর৤

ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত(১৮১২-৫৯)[৪৮] কবি৤

রাধানাথ শিকদার(১৮১৩-৭০)[৫৮]হিমালয়ের এভারেস্ট শৃঙ্গের উচ্চতা নির্ধারণ করেন৤

রেভারেন্ড কৃষ্ণমোহন বন্দ্যোপাধ্যায়(১৮১৩-৮৫)[৭৩]ডিরোজিওর শিষ্য৤খ্রিস্ট যাজক৤

রামতনু লাহিড়ী(১৮১৩-৯৮)[৮৬] শিক্ষাব্রতী, বিদ্যাসাগরের সহায়ক৤

প্যারীচাঁদ মিত্র(১৮১৪-৮০)[৬৭] টেকচাঁদ ঠাকুর লেখক ও মুক্তচিন্তার মানুষ৤

রেভারেন্ড জেমস লং(১৮১৪-৮৭)[৭৪] বাংলাভাষা ও সাহিত্যের উন্নয়নে বিশেষ যত্নশীল ছিলেন৤ বাংলা প্রবাদ বচন সংগ্রহ তাঁর অন্যতম কীর্তি৤

মদনমোহন তর্কালঙ্কার(১৮১৭-৫৮)[৪২] শিশুশিক্ষা বইয়ের লেখক, ’পাখি সব করে রব‘ তাঁর লেখা, বিদ্যাসাগরের সঙ্গী আন্দোলনকারী৤ তাঁর নামটা যত প্রাচীন কর্মে ততো আধুনিক৤

দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর(১৮১৭-১৯০৫)[৮৯] ব্রাহ্ম৤ রবীন্দ্রনাথের বাবা৤
 

বিদ্যাসাগরের পরে---

অক্ষয়কুমার দত্ত(১৮২০-৮৬)[৬৭] সাহিত্যসাধক, সমাজসংস্কারক৤

রামনারায়ণ তর্করত্ন(১৮২২-৮৬)[৬৫] নাট্যকার৤ ’কুলীনকুল সর্বস্ব‘ তাঁর রচনা৤

রাজেন্দ্রলাল মিত্র(১৮২২-৯১)[৭০] ভারত চর্চার অন্যতম পথিকৃৎ৤

হরিশ্চন্দ্র মুখোপাধ্যায়(১৮২৪-৬১)[৩৮] নির্ভীক ইতিহাসখ্যাত সাংবাদিক৤  

মধুসূদন দত্ত(১৮২৪-৭৩)[৫০] ’মেঘনাদ বধ‘ কাব্য রচয়িতা অমর কবি, নাট্যকার৤

রেভারেন্ড লালবিহারী দে(১৮২৪-৯৪)[৭১] শিক্ষাব্রতী, লেখক, সাংবাদিক, যাজক৤

ভূদেব মুখোপাধ্যায়(১৮২৭-৯৪)[৬৮] শিক্ষাব্রতী, মাইকেল মধুসূদনের সহপাঠী বন্ধু, বিদ্যাসাগরের বিধবা-বিবাহ প্রস্তাব তিনি সমর্থন করেননি৤

শ্যামাচরণ লাহিড়ি(১৮২৮-৯৫)[৬৮] গৃহী সন্ন্যাসী৤

দীনবন্ধু মিত্র(১৮৩০-৭৩)[৪৪] নীলদর্পণ নাটকের লেখক৤

তারকনাথ পালিত(১৮৩১-১৯১৪)[৮৪] এঁর দান করা বাড়িতে ক.বি. সায়েন্স কলেজ৤

কাঙাল হরিনাথ[মজুমদার](১৮৩৩-৯৬)[৬৪] সাংবাদিক৤

মহেন্দ্রলাল সরকার(১৮৩৩-১৯০৪)[৭২] চিকিৎসক(এয্‍‌লোপ্যাথি পরে হোমিওপ্যাথি)৤

বিহারীলাল চক্রবর্তী(১৮৩৫-৯৪)[৬০] কবি৤

’ভাই‘ গিরিশচন্দ্র সেন(১৮৩৫-১৯১০)[৭৬]কোরান শরীফের বাংলা অনুবাদক৤

শ্রীশচন্দ্র বিদ্যারত্ন(●--●) বিদ্যাসাগরের অনুজপ্রতিম বন্ধু৤ সংস্কৃত কলেজের অধ্যাপক৤ বিধবা বিবাহ আইন পাশ হবার পরে বালিকা বিধবা কালীমতী দেবীকে ১৮৫৬, ৭ডিসেম্বর তিনিই প্রথম বিবাহ করে সেযুগের রক্ষণশীল সমাজে বিপ্লবের সূচনা করেন৤

রামকৃষ্ণ পরমহংস(১৮৩৬-৮৬)[৫১] গদাধর চট্টোপাধ্যায় কালী সাধক যুগপুরুষ৤

ব্রহ্মানন্দ কেশবচন্দ্র সেন(১৮৩৮-৮৪)[৪৭] সমাজ সংস্কারক, জাতীয় চেতনার অন্যতম সূচনাকার৤

বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়(১৮৩৮-৯৪)[৫৭] সাহিত্যসম্রাট৤ ’বন্দেমাতরম‘ সংগীত তাঁর রচনা৤

বামাক্ষ্যাপা(১৮৩৮-১৯১১)[৭৪] বামাচরণ চট্টোপাধ্যায় তারাপীঠের কালী সাধক৤

কালীপ্রসন্ন সিংহ(১৮৪০-৭০)[৩১] হুতোম প্যাঁচার নক্সা-র লেখক৤

সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর(১৮৪২-১৯২৩)[৮২] ভারতের প্রথম আইসিএস(১৮৬৪)৤

উমেশচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়(১৮৪৪-১৯০৬)[৬৩][ডবলিউ সি ব্যানার্জি]কংগ্রেসের প্রথম সভাপতি৤

গিরিশচন্দ্র ঘোষ(১৮৪৪-১৯১২)[৬৯] নাট্যকার, অভিনেতা, গীতিকার৤

স্যার গুরুদাস বন্দ্যোপাধ্যায়(১৮৪৪-১৯১৮)[৭৫] কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম ভারতীয় ভাইস চ্যান্সেলর৤

শিবনাথ শাস্ত্রী(১৮৪৭-১৯১৯)[৭৩] লেখক, ব্রাহ্ম ধর্ম আন্দোলনের নেতা, বিদ্যাসাগরের সকল সমাজসংস্কারের সমর্থক৤

রমেশচন্দ্র দত্ত(১৮৪৮-১৯০৯)[৬২] ঐতিহাসিক, ঋক্‌বেদ সংহিতার অনুবাদক৤

সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়(১৮৪৮-১৯২৫)[৭৮] রাষ্ট্রগুরু বিশিষ্ট রাজীতিবিদ৤ ১৯০৫-এর বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে খ্যাত৤

জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর(১৮৪৯-১৯২৫)[৭৭] বহুমুখী প্রতিভা৤ সাহিত্যিক, বহু ব্যবসার উদ্যোগী, দেশপ্রেমিক, একাধিক ভাষায় দক্ষ, ছবি আঁকা,  সংগীতে দক্ষ এবং বাদক, ঠাকুর বাড়ির সন্তান৤ রবীন্দ্রনাথের বিকাশের প্রধান সহায়ক বড়দাদা৤

জ্ঞানদানন্দিনী দেবী(১৮৫১-১৯৪১)[৯১] জোড়াসাঁকোর ঠাকুর বাড়ির বধূ, বঙ্গনারীর সাজের দিশারী৤ 

মীর মোশারফ হোসেন(১৮৫৩-১৯২২)[৭০] বিষাদসিন্ধু, জমিদার দর্পণ গ্রন্থের লেখক৤

হরপ্রসাদ শাস্ত্রী(১৮৫৩-১৯৩৯)[৮৭] সংস্কৃত পণ্ডিত, বাংলাভাষা গবেষক৤ নেপাল থেকে দুর্লভ প্রাচীন পুথি সংগ্রহ করে বাংলাভাষার আদি গ্রন্থ ”চর্চাচর্য বিনিশ্চয়“ তথা ’হাজার বছরের পুরান বাংলা ভাষায় বৌদ্ধ গান ও দোঁহা‘ প্রকাশ করেন৤

জগদীশ চন্দ্র বসু(১৮৫৯-১৯৩৭)[৭৯] বিজ্ঞানী, গবেষক, উদ্ভিদের চেতনা বিষয়ে নতুন ধারণার প্রকাশক৤

যোগেশচন্দ্র রায় বিদ্যানিধি(১৮৫৯-১৯৫৬)[৯৮] পণ্ডিত, বাংলা বানানে দ্বিত্ব বর্জনের সূচনাকার৤

চন্দ্রমুখী বসু(১৮৬০-১৯৪৪)[৮৫] প্রথম বাঙালি মহিলা ক.বি. থেকে এম.এ.৤

ব্রহ্মবান্ধব উপাধ্যায়(১৮৬১-১৯০৭)[৪৭] প্রকৃত নাম ভবানীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় খ্রিস্টান হন, পরে আবার হিন্দু৤ শান্তিনিকেতনের আশ্রমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক৤

কাদম্বিনী গঙ্গোপাধ্যায়(১৮৬১-১৯২৩)[৬৩] পণ্ডিত, প্রথম প্রবেশিকা পরীক্ষায় পাশ, ও প্রথম গ্রাজুয়েট(চন্দ্রমুখী বসু সহ) মহিলা৤

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর(১৮৬১-১৯৪১, বাংলা ২৫ বৈশাখ ১২৬৮ - ২২শ্রাবণ ১৩৪৮)[৮১] বাংলা সাহিত্য, সংগীত, সংস্কৃতির দিশারী৤ ইউরোপের বাইরে সাহিত্যে প্রথম নোবেল প্রাপক৤ বিশ্বভারতীর প্রতিষ্ঠাতা৤

নীলরতন সরকার(১৮৬১-১৯৪৩)[৮৩] চিকিৎসক৤

আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়(১৮৬১-১৯৪৪)[৮৪] দেশজ বিজ্ঞানে আগ্রহী বিজ্ঞানী, বেঙ্গল কেমিক্যালের প্রতিষ্ঠাতা৤ বাঙালির উন্নয়নে আত্মনিবেদিত৤

 

       এসকল তারকা সন্নিবেশ ঘটেছিল বিদ্যাসাগরের কালে৤ ফলে যে সামগ্রিক সামাজিক প্রভাব তাঁর উপরে পড়েছিল তা আমরা দেখি তাঁর শিক্ষা বিস্তার প্রয়াসে, সমাজ উন্নয়নের কার্যাবলীর মধ্যে৤ তখনকার দিনের গোঁড়া সমাজে তিনি ছিলেন সম্পূর্ণ ব্যতিক্রম৤ তাঁর অগ্রগত ও উন্নত চিন্তাধারার সুফল আজ আমরা পাচ্ছি৤ অথচ তাঁকে যে কত হেনস্থা হতে হয়েছে ও অপমান সহ্য করতে হয়েছে তা এযুগে দাঁড়িয়ে অনুভব করা কঠিন৤ (একজন খ্যাত গায়ক তাঁর স্মৃতিচারণে সভায় দাঁড়িয়ে বলেছেন যে, বিদ্যাসাগরকে বাংলা থেকে তাড়াবার কালে ট্রেনের স্টেশনে তাঁর পিছনে ঘণ্টাকাঁসি বাজিয়ে দূর করে দেওয়া হয়৤ এই ঘটনায় ব্যথিত সেই গায়কের পরিবারে তিনদিন অরন্ধন শোক পালন করা হয়৤) বিদ্যাসাগর দেশ ও সমাজের জন্য নিজের জীবন উৎসর্গ করেছিলেন৤ তিনি তাঁর উচ্চ আয়ের প্রায় সবটাই বিলিয়ে দিয়ে নিজে অতি সাধারণভাবে জীবনযাপন করতেন৤ তিনি সমাজ সংস্কার করেন, এবং শিক্ষা সংস্কার যেমন করেন তেমনি বাংলাভাষার যে অভাবিত সংস্কার ও উন্নয়ন ঘটান তার ফলে বাংলাভাষা আজ এত উন্নত ও সমৃদ্ধ৤ তাঁর এই কাজের মূল বাহন হল তাঁর রচিত ”বর্ণপরিচয়“ শিশুপাঠ্য প্রাথমিক গ্রন্থ৤ তিনি ”বর্ণপরিচয়“ লেখেন তাঁর ৩৬ বছর বয়সে (প্রথম প্রকাশকাল ১৩ এপ্রিল, ১৮৫৫)৤ শোনা যায় তিনি যখন স্কুল পরিদর্শক ছিলেন, সে সময়ে কার্য উপলক্ষে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে যাবার ফাঁকে পালকিতে বসে বইখানি লেখেন৤ সম্ভবত স্কুলে বাংলা শিক্ষার যে দুরবস্থা তিনি দেখেন তা তাঁকে নাড়া দেয়, ও তিনি সঙ্গে সঙ্গে একখানি উপযুক্ত প্রাথমিক শিক্ষার বই(প্রাইমার) লেখায় হাত দেন৤ এটা তাঁর প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার ফল বলেই মনে হয়৤ তিনি নিজে ছিলেন সংস্কৃতের মহা পণ্ডিত, তাঁর চেতনা-বাহিত হয়ে এমন যুগান্তকারী বই আমরা বাংলার শিশুদের জন্য পেয়েছি৤ বাংলাভাষীদের জন্য পেয়েছি৤ বিদ্যাসাগর, রবীন্দ্রনাথ প্রমুখ অতি খ্যাত এবং মহাব্যস্ত মানুষেরা যে বাংলাভাষা ও শিশুশিক্ষার জন্য ভেবেছিলেন ও সময় দিয়েছিলেন তার পরিণত সুফল আমরা প্রজন্ম ধরে পেয়ে চলেছি৤

 

       বিদ্যাসাগর বাংলা বর্ণমালা থেকে অনেকগুলি বর্ণ বর্জন করেন, এবং অনেকগুলি বর্ণ গ্রহণ ও নতুন বর্ণ নির্মাণ করেন৤

বাংলা স্বরবর্ণ থেকে তিনি বর্জন করেন-- ৠ(দীর্ঘ ঋ), ৡ(দীর্ঘ লি), এবং অং অঃ এই মোট চারটি বর্ণ৤ ফলে বাংলা স্বরবর্ণ প্রচলিত ১৬টি থেকে হয়ে দাঁড়ায় ১২টি৤ আগে ছিল(ন্যাথানিয়েল ব্রাসি হ্যালহেড সাহেবের ’আ গ্রামার অব বেংগল ল্যাংগুয়েজ‘(A Grammar of the Bengal Language)বইতে --

 

অ আ ই ঈ

উ ঊ ঋ ৠ

ঌ ৡ এ ঐ

ও ঔ অ৹ অঃ

 

       বাংলা বর্ণমালায় এই মোট=১৬টি স্বরবর্ণ৤

 

এর থেকে ৠ(দীর্ঘ ঋ), ৡ(দীর্ঘ লি), অং[তখন অং ছিল=অ৹], অঃ এই মোট চারটি বর্ণ বর্জন করায় তা বিদ্যাসাগরের ”বর্ণপরিচয়“ বইতে দাঁড়ায় --

অ আ ই ঈ উ ঊ ঋ ঌ এ ঐ ও ঔ= ১২টি স্বরবর্ণ৤

       বিদ্যাসাগর বাংলা ব্যঞ্জনবর্ণও একইভাবে সংস্কার করেন৤ তাঁর আগে ন্যাথানিয়েল ব্রাসি হ্যালহেড সাহেবের ’আ গ্রামার অব বেংগল ল্যাংগুয়েজ‘(A Grammar of the Bengal Language)বইতে ব্যঞ্জনবর্ণ ছিল--

 

ক খ গ ঘ ঙ

চ ছ জ ঝ ঞ

ট ঠ ড ঢ ণ

ত থ দ ধ ন

প ফ ব ভ ম

য র ল ব __

শ ষ স হ ক্ষ

 

       বাংলা বর্ণমালায় এই মোট=৩৪টি ব্যঞ্জনবর্ণ৤

এখানে ণ-এর রূপ ছিল অনেকটা ’ল‘-এর মতো [ ]৤ আর র ছিল অসমীয়া হরফের মতো ৱ৤ আর ঠ ছিল অনেকটা চ-এর মতো কেবল মাত্রার পিছনে একটু উঁচু করে রেখা টানা৤ ঞ-এর মাত্রা ছিল৤ ট-এর মাত্রা ছিল, আর ট-এর ইলেক বা টিকি ছিল মাত্রার নীচেই৤

 

চিত্রে দেখা যাক

 

      
    এর থেকে ’ক্ষ‘ এই বর্ণটি বর্জন করায় তা বিদ্যাসাগরের ”বর্ণপরিচয়“ বইতে দাঁড়ায় মোট ৩৩ বর্ণ৤ বিদ্যাসাগর ব্যঞ্জনবর্ণে যোগ করেন--

ড় ঢ় য় ‍ং ‍ঃ এই মোট পাঁচটি৤ এতে ব্যঞ্জনবর্ণ দাঁড়ায় মোট ৩৮ বর্ণ৤ তিনি নতুন বর্ণ নির্মাণ করেন একটি ”  ‍ঁ “৤ এতে ব্যঞ্জনবর্ণ দাঁড়ায় মোট ৩৯ বর্ণ৤ এর পরে বিদ্যাসাগর ব্যঞ্জনবর্ণে আর একটি নতুন বর্ণ যোগ করেন, ” ৎ “, ফলে মোট বাংলা ব্যঞ্জনবর্ণ দাঁড়ায় ৪০টি৤

       একটি বর্ণ(ক্ষ) বর্জন, পাঁচটি বর্ণ(ড়ঢ়য় ‍ং ‍ঃ) গ্রহণ, দুটি বর্ণ ( ‍ঁ ৎ) নির্মাণ ইত্যাদি করার পরে বিদ্যাসাগরের ”বর্ণপরিচয়“ বইতে মোট বাংলা বর্ণ দাঁড়ায়-- ৩৪-১=৩৩+৫=৩৮+২=৪০

 

তাঁর সংস্কার করা বাংলা ব্যঞ্জনবর্ণসমূহ হল--

 

ক খ গ ঘ ঙ

চ ছ জ ঝ ঞ

ট ঠ ড ঢ ণ

ত থ দ ধ ন

প ফ ব ভ ম

য র ল ব শ

ষ স হ ড় ঢ়

য় ৎ ‍ং ‍ঃ  ‍ঁ

 

       বাংলা বর্ণমালায় এই মোট=৪০টি ব্যঞ্জনবর্ণ৤

 

সাম্প্রতিক --

 

       ১৯৮১-তে পশ্চিমবঙ্গ সরকার ব্যঞ্জনবর্ণ থেকে অন্তস্থ-ব(ৱ) বাতিল করায় ব্যঞ্জনবর্ণ দাঁড়ায়= ৩৯ বর্ণ৤

       আর ব্যবহারের অভাবে বাংলা স্বরবর্ণ থেকে আপনিই বাতিল হয়ে যায় ঌ(লি) বর্ণটি৤ তাই বাংলা স্বরবর্ণ দাঁড়ায় =১১টি৤

       ফলে চূড়ান্তভাবে বাংলা বর্ণমালা হয়েছে ১২-১=১১, ৪০-১=৩৯৤ সুতরাং বাংলা বর্ণমালায় বর্তমানে মোট বর্ণ দাঁড়িয়েছে ১১+৩৯=৫০টি৤

       বাংলা বর্ণমালা বিদ্যাসাগরের আগে ছিল ৫০টি, সেখান থেকে বিদ্যাসাগরের হাতে হয় ৫২টি, পরে ঌ বিলুপ্ত ও অন্তস্থ-ব বর্জিত হয়ওয়ায় এখন চূড়ান্তভাবে মোট বাংলা বর্ণমালা হয়েছে ১১+৩৯=৫০টি৤  

 

=========

 

HTML Comment Box is loading comments...

free counters
Back

Search site

পরিচালনায়- নাজমুল হাসান >>>> সম্পাদনায়-আরাফাত রহমান রানা

obj=new Object;obj.clockfile="5031-blue.swf";obj.TimeZone="GMT0600";obj.width=145;obj.height=50;obj.wmode="transparent";showClock(obj);